বাঙলা প্রতিদিন রিপোর্ট : দেশের শেয়ারবাজারে আওয়ামী শাসনামলে দফায় দফায় কেলেঙ্কারি ও ধসের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের বড় ধসকালে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়।
দেশের শেয়ারবাজারে গতি ফিরবে এমন প্রত্যাশা তাদের। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পুনর্গঠিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিনিয়োগকারীদের সেই আস্থা ফেরাতে পারেনি।
অথচ একই সময়ে পুনর্গঠিত ব্যাংকিং খাতে আমানতকারীদের আস্থার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এ খাতে বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। ফলে এরই মধ্যে ব্যাংক খাত দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। সে হিসাবে উল্টোচিত্র দেশের শেয়ারবাজারে।
যতই দিন যাচ্ছে, দেশের পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। অব্যাহত দরপতনে আবারও এই সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। পটপরিবর্তন পুঁজিবাজারে কোনো উন্নতি আনতে পারেনি। বিনিয়োগকারীরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ৭০ শতাংশ বিক্রির চাপে ছিল গত সপ্তাহে। তারা টাকা তুলে নিচ্ছে।
এতে গত সপ্তাহে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন কমেছে ২৫ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। ডিএসইতে শেয়ারদর হারিয়েছে ৮৩.৫৮ শতাংশ কোম্পানি। হতাশায় বিনিয়োগকারীরা মাঠে নামেন। শনিবারের (গতকাল) মধ্যে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগের আলটিমেটাম দেন তারা। তা না হলে আজ রবিবার থেকে লাগাতার কর্মসূচি দেবেন বিনিয়োগকারীরা।
ডিএসইর সাপ্তাহিক বাজার বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, গেল সপ্তাহের প্রতিদিনই পুঁজিবাজারের সূচকের উত্থান-পতনে ছিল পাগলা ঘোড়ার মতো। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আরও ১৭৬.৫৫ পয়েন্ট বা ৩.১৩ শতাংশ কমে পাঁচ হাজার ৪৬২.৫৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
আর পুরো সপ্তাহে শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ৪০.৬৭ পয়েন্ট বা ৩.২২ শতাংশ হারিয়ে এক হাজার ২২১.২৭ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৭৪.০৮ পয়েন্ট বা ৩.৫৯ শতাংশ হারিয়ে এক হাজার ৯৯০.৮৫ পয়েন্টে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ডিএসএমইএক্স সূচক ৫৮.৩৩ পয়েন্ট বা ৪.৭৪ শতাংশ হারিয়ে এখন এক হাজার ১৭২.৯৭ পয়েন্টে। গত বছরের এই দিনের তুলনায় সূচক হারানোর হার পাঁচগুণ বেড়েছে।
বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে মোট ৩৯৬ প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৫৭টির, কমেছে ৩৩১টির বা ৮৩.৫৮ শতাংশের এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৮টি প্রতিষ্ঠানের দর। ডিএসইতে ৮১ কোটি ৫৭ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার বাজারমূল্য দুই হাজার ১৩১ কোটি ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। আর আগের সপ্তাহে মোট লেনদেন হয়েছিল তিন হাজার ৩৯৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকার।
অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইতে লেনদেন কমেছে এক হাজার ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। গড় লেনদেন কমেছে টাকায় ৩৭.২৫ শতাংশ। যেখানে আগের সপ্তাহে গড়ে ৬৭৯ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকায় গড়ে ২২ কোটি ৫৩ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড হাতবদল হয়েছিল, সেখানে সদ্যবিদায়ী সপ্তাহে সেটি ছিল ৪২৬ কোটি ২১ লাখ ৯০ হাজার টাকায় গড়ে ১৬ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড।
সদ্যবিদায়ী সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইতে বাজারমূলধন ছিল ছয় লাখ ৮৫ হাজার ৬২১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আর সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস লেনদেন শেষে বাজার মূলধন এক দশমিক ৯৭ শতাংশ উধাও হয়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৭২ হাজার ১১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকায়।
অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে ১৩ হাজার ৫৫০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এসএমই মার্কেটে ৫৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে বলে ডিএসইর সাপ্তাহিক বাজার বিশ্লেষণের তথ্য থেকে জানা গেছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টকের সাপ্তাহিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিটি সূচক থেকে গড়ে তিনশ পয়েন্টের বেশি হারিয়েছে গত সপ্তাহে। বিদায়ী সপ্তাহে সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৫২১.৪৪ পয়েন্ট বা ৩.৩০ শতাংশ হারিয়ে এখন ১৫ হাজার ২৭১.৭৭ পয়েন্টে, সিএসসিএক্স ২৯৬.২৯ পয়েন্ট বা ৩.০৯ শতাংশ হারিয়ে ৯ হাজার ২৭৫.০৩ পয়েন্টে এবং সিএসই-৩০ সূচক ৩৬৫.৮০ পয়েন্ট হারিয়ে এখন ১২ হাজার ৪৫৭.৩৪ পয়েন্টে অবস্থান করছে। সপ্তাহজুড়ে সিএসইতে ৩১৪ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৫২টির, কমেছে ২৫২টির বা ৮০.২৫ শতাংশের এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১০টির।
গেল সপ্তাহটিতে ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮৫ টাকায় মোট এক কোটি ৩৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯১টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড হাতবদল হয়েছে। এই বাজারে গেল সপ্তাহে বাজার মূলধন কমেছে ১২ হাজার ১১০ কোটি টাকা। সপ্তাহ শুরুতে বাজার মূলধন ছিল সাত লাখ ২০ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। যেখানে সপ্তাহ শেষে কমে এখন সাত লাখ ৮ হাজার ৪৪ কোটি টাকায় নেমেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, শেয়ারবাজার আস্থার জায়গা হারিয়েছে। কমিশনকে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের আশান্বিত করতে পারেনি। বাজারে অবশ্যই সংস্কার দরকার। কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছরের জঞ্জাল একদিনে শেষ করা যাবে না। শেয়ারবাজার একটি সংবেদনশীল জায়গা। এ জন্য বাজার পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে হবে। তা না হলে উল্টো রেজাল্ট হবে।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক ডা. মোহসিন গতকাল বলেন, চেয়ারম্যান পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাকে পদত্যাগের আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি পদত্যাগ না করায় আমাদের আন্দোলন চলবে। আজ রবিবার সকালে বিএসইসি ঘেরাও হবে। বিকাল ৩টায় রাজধানীর বক চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানানো হবে।