ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ : বিশ্বপ্রজন্মের দীক্ষার এক অনন্য দলিল

মোহাম্মদ আলী আশরাফ : বাংলাদেশের ইতিহাস পরিক্রমা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে যে দিনগুলো আমাদের সামনে ধ্রুবতারার ন্যায় উদ্ভাসিত হয় তার মধ্যে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ অন্যতম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আঠারো মিনিটের সেই ভাষণটির রাজনৈতিক তাৎপর্য ও রাজনৈতিক নান্দনিকতা (Political Aesthetics or Political rhetorics) বিশ্লেষণ জরুরি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালির হৃদস্পন্দনগুলো অনুভব করে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক কাব্য তাৎক্ষণিক গাঁথা শুরু করেন। বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো যে যুগসন্ধিক্ষণে এসে পরিপূর্ণতার ধাবিত করে , সেই দিনটি ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ নিয়ে বলার আগে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের ক্ষমতা লিপ্সার বিষয়ে আলোকপাত জরুরি।

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে পাকিস্তানি হায়েনাদের নগ্নতা প্রকাশ পায়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, We won’t allow these black bastards to rule over us. ক্ষমতালোভী পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের রায়কে পদদলিত করতে মরিয়া হয়ে উঠে।

যেকোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া যাবেনা। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের সেই নীলনকশায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলি ভুট্টো হাত মিলায়। ষড়যন্ত্রের ফন্দি আঁটে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতে কোনো ক্রমেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না।

পাকিস্তানিদের সামরিক শাসকদের অশুভ পাঁয়তারা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন। তাই বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসমাবেশ আহবান করেন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের রোষানল, অপরদিকে মুক্তিকামী মানুষের চাপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও পরিপক্কতা উক্ত ভাষণে প্রতিফলিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের আন্দোলন-সংগ্রামের লক্ষ্য, চূড়ান্ত স্বাধীনতার বার্তা, জনগণকে ভালোবাসার স্বতস্ফূর্ততা ও গণ-আকাক্সক্ষার রণধ্বনি প্রতিফলিত হয় সেদিনের সেই মহাকাব্যিক ভাষণে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্থানীয় সময় ২.৩০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মঞ্চে ওঠেন।

অপরদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার আকাশে উড়ছে, গণসমাবেশের গতি-প্রকৃতির উপর কঠোর নজরদারি রাখছে। পাকিস্তান রেডিওর ঢাকার সাবস্টেশনে কর্মরত বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ লাইভ সম্প্রচার করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের পক্ষ থেকে কঠিন বাধা আসছে। তবুও বাঙালিরা অনড়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠস্বরকে (Voice of the seventy five million people) সম্প্রচার করবেই।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তিকামী মানুষের ও মুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী জনগণের জন্য একটি পরিপূর্ণ বার্তা প্রেরিত হয়। বার্তাটি ছিল, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ঘোষণা দ্বারা বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সবুজসংকেত দিয়ে দিয়েছেন। ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক’, ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’- এমন ইস্পাত কঠিন উচ্চারণ দ্বারা বঙ্গবন্ধু মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে তীব্রভাবে আলোড়িত করে ‘চূড়ান্ত স্বাধীন বাংলাদেশের’ অভিমুখে নিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু তাঁর উপলব্ধির জায়গা থেকে ভাষণে এমন চারটি শর্ত জুড়ে দিলেন যা কখনো পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা পূর্ণ করতে পারবে না। তিনি যে চারটি শর্ত দিলেন- সামরিক শাসন (মার্শাল ল) তুলে নেওয়া, জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এরং নিরীহ বাঙালিকে হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত।

বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন, পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা কোনো শর্তই পূরণ করবে না, বরং তারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুক্তিকামী মানুষকে দমিয়ে রেখে এদেশের মাটি দখলের পাঁয়তারা করছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে বাঙালি জাতি অবিভূত। জনসমুদ্রের জনস্রোত (Receding tides) পরিপূর্ণ বার্তা পেয়ে তৃপ্ততা নিয়ে বেরিয়ে আসল।

পাকিস্তানি লেখক মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘Witness to Surrender’ বইতে উল্লেখ করেন, The crowd was like a religious congregation returning from mosque or church after listening to a satisfying sermon. এ উক্তটি থেকে উপলব্ধি করা যায়, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে মুক্তিকামী মানুষের চূড়ান্ত আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।

৭ মার্চের সবুজসংকেতের পর এ ভূখণ্ড বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হয়। ভাষণে তিনি সব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মবিরতি পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং মাস শেষে বেতনভাতা আনতে বলেছেন। সরকারি সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

তাঁর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িটি সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়। মূলত বত্রিশ নম্বর বাড়িটি পূর্ববাংলা পরিচালনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত পূর্ববাংলা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পরিচালিত হয়। বত্রিশ নম্বর বাড়িটি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পরিণত হয় যেখান থেকে পূর্ববাংলা পরিচালনার চূড়ান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়। অপরদিকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা সময়ক্ষেপণ না করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানি করে। মুক্তিকামী বাঙালিদের উচিত শিক্ষা দিতে পোড়ামাটির নীতি অনুসরণ করে। মানুষ চাই না, মাটি চাই- এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নীলনকশার ছক আঁকে।

‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এক ষড়যন্ত্রের নীলনকশার নাম। বেলুচের কসাইখ্যাত টিক্কা খানকে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব দিলো পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। অপারেশন শুরুর আগে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সামনের সাড়ির নেতৃবৃন্দসহ অন্যান্য ছাত্রনেতা, সংস্কৃতি কর্মী ও শিক্ষকদের বন্দি করার নির্দেশনা রয়েছে নীলনকশার ফরমানটিতে।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে ইপিআরের মাধ্যমে ২৫ মার্চ রাতে (মূলত ২৬ মার্চ) চূড়ান্ত ঘোষণা দিলেন : This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you may be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.

বঙ্গবন্ধু তাঁর বত্রিশ নম্বর বাড়িতে অপেক্ষায় ছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালালো। Siddik Salik ‘Witness to Surrender’ উল্লেখ করেন, মেজর জাফর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে যে মন্তব্যের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করে তা ছিল, ‘BIG BIRD IN THE CAGE, OTHERS NOT IN THEIR NESTS.’

কাজেই পাকিস্তানি লেখক মেজর সিদ্দিক সালিকের বইতে মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘ইরম ইরৎফ’কে আটক করে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। অন্য কোনো ‘Big Bird’কে সেদিন গ্রেপ্তার করা হয়নি। কাজেই স্বাধীনতার প্রশ্নে পাকিস্তানিদের কাছে ‘বড় পাখিটি’ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। হানাদাররা বুঝেছিল, বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করতে পারলে বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু গ্রেপ্তারের পূর্বেই তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের সব রূপরেখা দিয়েছেন।

বিপ্লবের ইতিহাসে, মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির ইতিহাসে সর্বোপরি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসে ক্ষণজন্মা নেতাদের দূরদর্শী নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ ও কালজয়ী কণ্ঠস্বর প্রজন্মকে উজ্জীবিত করে এবং পূর্বপুরুষের শেকড়ের আত্ম-অনুসন্ধান দ্বারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথ নির্মাণ করেন। অবিসংবাদিত নেতাদের অন্তর্নিহিত চেতনাগত বোধ তাঁদের কথনে-বলনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কালজয়ী কণ্ঠস্বরগুলো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথকে সুগম করে লক্ষ্যে নিয়ে যায়।

বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যে কালজয়ী ভাষণগুলো দেদীপ্যমান তার মধ্যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘I have a dream’ এবং আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গের প্রেসিডেনশিয়াল আড্রেস, ‘That government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth’- আজও মানুষ এ তাঁদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণের কথা বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ দুই ব্যক্তির ত্যাগ ও সংগ্রামের কথা সর্বজন স্বীকৃত। শক্তিশালী আমেরিকার ভিত গঠনে তাঁরা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ (The struggle this time is the struggle for emancipation! The struggle this time is the struggle for independence!)- এই কালজয়ী ভাষণটির রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও আন্তর্জাতিক তাৎপর্য মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাষণের সমকক্ষ ও সমপর্যায়ের।

এই তিন অবিসংবাদিত নেতার জীবনী বিশ্লেষণ করলে আরো একটি মিল আমাদের চোখে ধরা পরে। তিনজনই মানুষকে কণ্ঠস্বরের জাদুতে বিমোহিত করতে পারতেন, উজ্জীবিত করতে পারতেন এবং তিনজনই মানুষের অধিকার নিয়ে, ন্যায়বিচার নিয়ে কণ্ঠস্বর সোচ্চার রেখেছেন। বৈষম্য, অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অগ্রসেনানীর ভূমিকা পালন করেছেন।

তাঁরা তিনজনই আততায়ীর হাতে জীবন দিয়েছেন। এই তিন কালজয়ী কণ্ঠস্বর তাঁদের বুকের তাজা রক্তে ইতিহাসের বুনন জমাটবদ্ধ করে প্রজন্মের কাছে রেখে গেছেন।

‘মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ বঙ্গবন্ধুর এ কালজয়ী ভাষণটি ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজেস’ হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে । বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেস্কো।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি সংকট মোকাবেলায় আমাদের অনুপ্রেরণা দিবে, সাহস ও শক্তি যোগাবে এবং আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে ভাষণটি হবে আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা;