# পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রয়েছে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান
# দেশে টার্গেট খুন করতে করা হয় পরিকল্পনা, এখনো চাঁদাবাজি চলছে তাদের নামেই
# পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে পুলিশ
বিশেষ প্রতিবেদক : খুনি সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিখ্যাত শহর দুবাই। দেশে নানা অপরাধ করে সন্ত্রাসীরা কৌশলে পালিয়ে আস্তানা গড়ছে বিশ্বের অন্যতম এ পর্যটন নগরীতে। এছাড়াও দেশের অন্যতম পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকের অবস্থানও এ শহরে। আবার বিভিন্ন দেশে থাকা ওই সকল সন্ত্রাসীরা একত্রে মিলিত হয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে হত্যারও পরিকল্পনা করে।
সম্প্রতি মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা হয় এ শহরে থাকা বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের মাধ্যমে। এছাড়াও বর্তমানে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি বিতর্কিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ এই শহরে অবস্থান করায় এ নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে।
দেশ থেকে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়ে এমনিতেই ঠিকাদার, ডেভেলপার, ব্যবসায়ীসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা তটস্থ থাকেন। তাদের নামে নিয়মিত চাঁদাও দাবি করা হয়। চাঁদা না দিলে দেয়া হয় হত্যার হুমকি। এছাড়াও দেশে খুন করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। এমন অবস্থাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে এসব ব্যবসায়ীদের মাঝে। দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে না পারার কারণে অনেক সন্ত্রাসী বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন অনেকে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, দেশ ছেড়ে পালানো অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে হলে আন্তদেশীয় যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, যে সকল দেশে আমাদের দেশের খুনি, সন্ত্রাসীরা অবস্থান করছে সে সকল দেশের পুলিশের সঙ্গে আমাদের বন্দি বিনিময় চুক্তি করা আবশ্যক। চুক্তির ফলেই কেবলমাত্র তাদের গ্রেফতার করে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অন্যথায় তাদের ফিরিয়ে আনা যাবে না।
সূত্র মতে, ২০১৮ সালের ৯ জুলাই গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় উলুখোলা এলাকার একটি জঙ্গল থেকে পুলিশ পরিদর্শক মামুনের হাত-পা বাঁধা বস্তাবন্দি পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ওই খুনের আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন বর্তমানে আলোচিত আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম। দেশ থেকে পালিয়ে তিনি প্রথমে ভারত যান। কলকাতার একটি বস্তিতে কয়েকবছর বসবাস করার পর তিনি আরাভ খান নামে ভুয়া ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করে দুবাই চলে যান। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী।
সম্প্রতি সেই স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে যান ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, হিরো আলম, দিঘিসহ কিছু সেলিব্রেটি। আর তাতেই ঘটনা ফাঁস হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তাকে গ্রেফতারে পুলিশ এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে আবারও আলোচনায় এসেছে দুবাইয়ের নাম।
জানা যায়, দেশের অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানার শহর এখন দুবাই। কেননা আলোচিত হত্যাকান্ডের আসামিরা কৌশলে পালিয়ে সেই শহরেই আস্তানা গাড়ে। এমনকি দেশে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কিভাবে খুন করবে তার পরিকল্পনাও হয় দুবাই শহরে। এ ছাড়াও দুবাইয়ে এখন অবস্থান করছেন আলোচিত সন্ত্রাসী জিসান, জাফর আহমেদ মানিক, শাহাদাৎসহ আরো কিছু সন্ত্রাসী। আবার বিশ্বের অনেক শহরে অবস্থানরত আমাদের দেশের সন্ত্রাসীরা ওই শহরে মিলিতও হয়।
তারা বলছেন, জাহিদুল ইসলাম টিপুর হত্যাকান্ডটি দুবাই শহরে বসেই পরিকল্পনা হয়। এতে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকসহ আরো কয়েকজন অংশ নেয়।
দুবাইয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আস্তানা : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত এক দশকে দেশের শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর নাম তালিকাভুক্ত করেছে। তাদের অন্যতম হলেন জিসান। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ফকিরাপুল, পল্টন মতিঝিলসহ বেশ কিছু এলাকায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ওইসব এলাকার সরকারি ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন তিনি। ইন্টারপোল তার নামে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে।
২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুজন ডিবি পুলিশকে হত্যার পর আলোচনায় আসে জিসান। এরপরই গা ঢাকা দেয় সে। ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে সে দেশ ছাড়ে বলে ধারণা করা হয়।
সূত্র জানায়, সে সময় পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন জিসান। এরপর নিজের নাম পরিবর্তন করে আলী আকবর চৌধুরী নামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঠিকানা দেখানো হয়েছে সারদা পল্লী, ঘানাইলা, মালুগ্রাম শিলচর, চাষার, আসাম। বাবার নাম হাবিবুর রহমান চৌধুরী। মায়ের নাম শাফিতুন্নেছা চৌধুরী। আর স্ত্রীর নামের স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে রিনাজ বেগম চৌধুরী। পাসপোর্ট ইস্যুর স্থান দুবাই হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুবাইয়ে তার দুটি রেস্টুরেন্ট আছে; আছে গাড়ির ব্যবসাও। এসব দেখভাল করেন তার ছোট ভাই শামীম এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শাকিল মাজহার। এরমধ্যে শাকিল মাজহার যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সহসম্পাদক রাজিব হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। এ হত্যাকান্ডের পর পালিয়ে দুবাই চলে যান তিনি।
রাজধানীর আরেক সন্ত্রাসী শাহাদাৎ। মিরপুর এলাকায় তিনি ছিলেন সবার কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। ওই সময় তিনি মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মূলত ২০০২ সালের ১০ মে কমিশনার সাইদুর রহমান নিউটন হত্যাকান্ডের পর দেশ ছাড়েন শাহাদাত। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ দেড় ডজন মামলা রয়েছে। পুলিশের খাতায় শাহাদাত মোস্ট ওয়ানটেড হিসেবে তালিকাভুক্ত।
যে ক’জন পলাতক আসামিকে গ্রেফতারে বাংলাদেশ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে শাহাদাত তাদের মধ্যে প্রথম সারির একজন।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে শাহাদাত প্রথমে ভারতে আশ্রয় নেন। ভারতে তার স্থায়ী বসবাসের খবর পাওয়া গেলেও তিনি মাঝে মধ্যে দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশেও নিয়মিত যাতায়াত করেন বলে জানা যায়।
মূলত দুবাইয়ে জিসানের সঙ্গে দেখা করে দেশে হত্যা, চাঁদাবাজির ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেন। তার কাছে বিশ্বের একাধিক দেশের পাসপোর্টও রয়েছে।
শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক। মতিঝিল, পল্টন, খিলগাঁও, সবুজবাগ, শাহজাহানপুর ও রামপুরাসহ আশপাশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একসময় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তার। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ এ সন্ত্রাসী ভারতে গা ঢাকা দিয়ে সেখানে বসেই নিয়ন্ত্রণ করতেন সব। তবে এখন ভারত ছেড়ে দুবাইয়ে অবস্থান তার।
১৯৮৯ সালের ১৩ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করে। ওই মামলায় মানিকের সাজা হয়। জোট সরকারের আমলে পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন তিনি।
যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যার অন্যতম আসামি আরেক যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ভাটারাসহ আশপাশের পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। যুবলীগের অভ্যন্তরীণ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মিল্কি হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চঞ্চলসহ আরো বেশ কয়েকজন আসামি রয়েছে। মূলত এ ঘটনার পর তিনি দুবাই চলে যান। এরপর সেখান থেকে আমেরিকা। তবে জিসানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় মাঝে মধ্যে তাকেও দুবাইয়ে দেখা যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ হত্যা মামলার আসামি আরাভকে আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে ইন্টারপোলকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের অনেক সন্ত্রাসী, অপরাধী বিদেশের বিভিন্ন শহরে রয়েছে। তাদেরকেও ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, আরাভকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। তবে আমাদের আরও কিছু অপরাধী রয়েছে দেশের বাইরে। তাদেরও ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
