নিজস্ব প্রতিবেদক : গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে শিল্প খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। বাসা-বাড়িতেও দিনের বেলায় মিলছে না গ্যাস। এমন পরিস্থিতিতে আবারো গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ইঙ্গিত মিলেছে।
সা¤প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, চাহিদার চেয়ে সরবরাহের পরিমাণ প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে গেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে দৈনিক ৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট। আগামী দুই সপ্তাহে তা আরো বাড়তে পারে। এরপর ঘাটতি কিছুটা কমার পূর্বাভাস থাকলেও চাহিদার এক চতুর্থাংশের জোগান দেয়া শিগগিরই সম্ভব হবে না। পরিস্থিতি সামলাতে কাতার এবং ওমান থেকে ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পরিমাণ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। তবে তা খুব সহসাই সম্ভব হবে না। যার কারণে এই সংকট দ্রæত কমার সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আজকেই আমি বিদেশী ক্রেতাদের নিয়ে ফ্যাক্টরিতে গিয়ে দেখি ডায়িং বন্ধ। তখন সংশ্লিষ্টরা আমাকে জানাল, গ্যাসের সংকটের কারণে ডায়িং বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এই পরিস্থিতিতে সঠিক সময়ে বিদেশে কিভাবে পণ্য পাঠানো যাবে। অথচ এখন আমাদের অর্ডারও বেশি। আমি সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজ খবর নিচ্ছি। অন্যদের সমস্যাগুলো জেনে খুব শিগগিরই পেট্রোবাংলা বা তিতাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা বসব।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গত বুধবার তার ফেসবুক পেইজে একটা পোস্টে বলেছেন, ‘কারিগরি কারণে ১২ থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিতাস গ্যাস অন্তর্গত এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করতে পারে। এজন্য তিতাস কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার এক তৃতীয়াংশে নেমে গেছে। ফলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে না শিল্প, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসহ শহর-গ্রামের নাগরিকরা। উৎপাদনের চাকা ধীর ও বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিবহণ খাতে রেশনিং করে সিএনজি সরবরাহ করায় বেড়ে গেছে যাতায়াতের খরচ। হ্রাস পেয়েছে কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সার উৎপাদনও।
গ্যাস সংকটের কারণে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, নিটিং কারখানাগুলোর সংকট চরম আকার নিয়েছে। ঠিক সময়ে পণ্য দিতে না পারার ঝুঁকিতে থাকা রফতানিকারকরা ক্রয়াদেশ বাতিলের আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, গ্যাস সংকটের স্থায়ী সমাধান দরকার। ঘাটতি দ্রæত মেটানো না গেলে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে দৈনিক ৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। অথচ পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। গত দুই-তিন বছর ধরে দৈনিক ৪১০-৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার ৩১০ থেকে ৩৩০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছিল। গত ৯ জানুয়ারি ২৫৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। গত ১৮ নভেম্বর সামিটের এলএনজি টার্মিনালের মুরিং ছিড়ে যায়। এতে টার্মিনালটিতে কোন এলএনজিবাহী কার্গো ভিড়তে পারছে না। এতে দৈনিক প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে শিল্পের পাশাপাশি রাজধানীর বহু এলাকায় বাসাবাড়িতে দিনের অধিকাংশ সময়ে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও পাওয়া গেলেও গ্যাসের চাপ থাকছে কম।
শিল্প-কারখানায় গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, গ্যাস সংকট এখন তীব্রতর হয়েছে। এতে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না। অথচ কয়েকদফা গ্যাসের দামও বাড়িয়েছে সরকার।
এদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়াতে চায়। গ্যাসের দাম সমন্বয় করার জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব দিয়েছে তারা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তারা আমাদের কাছে সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আইনগতভাবে আমাদের পক্ষে সমন্বয়ের সুযোগ নেই। হয় দাম বাড়াতে হবে, নতুবা কমাতে হবে। আমরা এটা পারি। যে কারণে তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে আইনগতভাবে আবেদন করতে বলা হয়েছে। তাদের আবেদন আসলে আমরা গণশুনানিসহ যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার সেগুলো নেওয়া হবে। আর একথাও তো সত্যি সারা বিশ্বেই গ্যাসের দাম বাড়ছে। ফলে এগুলোও তো আমাদের ভাবতে হবে।’ এদিকে দুই একদিনের মধ্যেই বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধির আবেদন জমা দিবে বলে জানা গেছে।
জ্বালানি খাতের শীর্ষ সংস্থা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেছেন, দেশের গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং এলএনজি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সবধরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কয়েকটি গ্যাস ক‚পের ওয়ার্কওভার (সংস্কার) শেষ হওয়ার পথে। সেগুলোতে উৎপাদন শুরু ও বাড়লে সংকট কমবে। সামিটের এলএনজি ফের চালু হলেও সরবরাহ বাড়বে। এক্ষেত্রে এ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
