ছাড় দিতে নারাজ জাতীয় পাটি, দুর্গ ভাঙতে মরিয়া আওয়ামী লীগ

রংপুর ৬টি আসনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হাল

রংপুর ব্যুরো : ‘লাঙলের ঘাঁটি’ বলে পরিচিত রংপুর এখন দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে। একসময় রংপুরের ছয়টি আসন জাপার দখলে থাকলেও এখন রংপুর-১ ও রংপুর-৩ ছাড়া বাকি ৪টি আসন আওয়ামী লীগের দখলে।

রংপুরের ৬টি সংসদীয় আসনে দ্বাদশ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপিসহ অন্যান্য দল মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার জাপার দুর্গ ভাঙতে পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। সব দলেরই নেতারাই নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে ভাবছেন। আগামী বছরের শুরুতে সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। দ্বাদশ নির্বাচনে রংপুরের ৬টি সংসদীয় আসন নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ফারুক হোসেন;
রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) :
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ১ থেকে ৮ নম্বর ওয়ার্ড ও গঙ্গাচড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-১। এ আসনে স্বাধীনতার পর আটবার জাতীয় পার্টি দুই বার আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়েছেন। গঙ্গাচড়া আসনের এমপি জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব দল থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত মসিউর রহমান রাঙ্গা। জাতীয় পার্টির দ্বন্দ্ব নিরসন না হলে ওই আসনে জাতীয় পার্টি রাঙ্গার পরিবর্তে অন্য প্রার্থী দিবে। সেক্ষেত্রে রাঙ্গা কী করবেন এটা নিয়েও চলছে আলোচনা।

এ আসনে টানা চার মেয়াদে স্থানীয় কোনো নেতা সংসদ সদস্য হতে পারেননি। বহিরাগত প্রার্থীর বড় দলগুলো মনোনয়ন নিয়ে এ অঞ্চলের জণপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। এবার এ অঞ্চলে আওয়াজ ওঠেছে সংসদ সদস্য হতে হবে স্থানীয় লোকজন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্র্টি আর বিএনপিতে শোনা যাচ্ছে একই রব। এই আসনে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হাওয়ায় ভোটের লড়াই হবে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যেই।

আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু, গঙ্গাচড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আহŸায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমীন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু। শিল্পপতি সিএম সাদিক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন অনেকদিন ধরে।

জাতীয় পার্টি থেকে এরশাদের ভাতিজা সাবেক সংসদ সদস্য ও হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ এ আসনে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। রংপুরের এ আসনে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হলেও মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন দুইজন, গঙ্গচড়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াহেদুজ্জামান মাবু ও রংপুর জেলা আহবায়ক কমিটির সদস্য ও আলমবিদিতর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোকাররম হোসেন সুজন। এ আসনে রংপুর জেলা নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক খায়রুল আলম বাবুর নির্বাচন করার কথা শোনা যাচ্ছে।

রংপুর-২ (তারাগঞ্জ-বদরগঞ্জ) :
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-২ আসন। এ আসনে জাতীয় পার্টি পাঁচবার, আওয়ামী লীগ চারবার ও এক বার বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রংপুর-২ আসন বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক ডিউক চৌধুরী।

তিনি পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এবার তিনি মনোনয়ন পাবেন নাকি অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে এ নিয়ে চলছে আলোচনা। তবে জাতীয় পার্টিও এই আসনে প্রার্থী দিবে এমনটা দাবি করছেন জেলা জাপার নেতারা।

এখানের জাপার সাবেক এমপি আনিছুল হক মন্ডল ও অ্যাড মোকাম্মেল হোসেন চৌধুরীর নাম শোনা যাচ্ছে। রংপুর-২ আসনে বিএনপি বরাবরই দুর্বল। তবে বিএনপির দুই সাবেক এমপি মো. আলী সরকার ও পরিতোষ চক্রবর্তী এবং সাবেক ছাত্র নেতা মাহফুজ উন নবী ডনের কথা শোনা যাচ্ছে। তারা ভিতরে ভিতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমনটাই শোনা যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন বদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ সাবেক চেয়ারম্যান ও কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় নেতা কৃষিবিদ বিশ^নাথ সরকার বিটু ও বদরগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র উত্তম কুমার সাহা ।

রংপুর-৩ (সদর) :
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-৩ আসন। স্বাধীনতার পর এ আসনটি জাপার দখলে রয়েছে। এ আসনের বর্তমান সাংসদ রয়েছেন প্রয়াত জাতীয় পার্টিও চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পুত্র সাদ এরশাদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এ আসনে পরপর চারবার এমপি নির্বাচিত হন। তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে তার পুত্র সাদ এরশাদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

অনেকে মনে করছেন এই আসনটি কৌশলের কারণে জাপাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবার সদর আসন ছাড় দিতে নারাজ।

এ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেনÑ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও সাবেক সাংসদ হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবির) পরিচালক অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম, রংপুর মহানগরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মন্ডল।

বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি এখানে দুর্বল হলেও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী রংপুর মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহŸায়ক রিটা রহমান ও মহানগর বিএনপির আহবায়ক সামসুজ্জামান সামু।

রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা) :
কাউনিয়া ও পীরগাছা নিয়ে গঠিত এ আসন রংপুর-৪। এ আসনে স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করতে না পারলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ইতিহাস গড়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নেয় বিশিষ্ট শিল্পপতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা টিপু মুনশি।

নৌকা প্রতীক নিয়ে পরপর দ্বিতীয় মেয়াদের এমপি রয়েছেন তিনি। এবারও তিনি মনোনয়ন চাইবেন। স্থানীয় নেতাকর্মীরা সেখানে তার বিকল্প কাউকে দেখছেন না। তবে আওয়ামী লীগের তরুণ উদীয়মান নেতা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মনোয়ারুল ইসলাম মাসুদ রংপুর ৪ আসনের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।

এছাড়াও পীরগাছা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবু নাসের শাহ মো. মাহবুবার রহমান এ আসনের মনোনয়ন পেতে জোর লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। রংপরের এ আসনটিতে বিএনপির অবস্থা আগে থেকেই কিছুটা নড়েবড়ে। কিন্তু বিগত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এমদাদুল হক ভরসা এক লাখের বেশি ভোট পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। এবার এমদাদুল হক ভরসা ছাড়াও বিএনপির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আফসার আলীর নাম শোনা যাচ্ছে।

রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) :
এ আসনের এমপি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান। এই আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে বিভক্তি রয়েছে। এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের পৃথক দুটি গ্রæপ পৃথকভাবে দলীয় এবং জাতীয় কর্মসূচি পালন করায় নেতাকর্মীদের মাঝে বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়েছে। এই আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারে।

আওয়ামী লীগ থেকে সাবেক ছাত্রনেতা মোতাহার হোসেন মন্ডল মওলা মনোনয়ন পেতে তদবির করছেন। এছাড়া মিঠাপুকুরে জামায়াত শিবিরের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তবে এই আসনটিও ছাড় দিতে নারাজ জাতীয় পাটি ও বিএনপি।

এখানে বিএনপির যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন, উপজেলা আহবায়ক গোলাম রব্বানি ও সাজেদুর রহমান। তবে কেউ কেউ বলছেন এই আসনে জামায়াত প্রার্থী দিতে পারে। তবে এখানে জেলার জাপার সাবেক সভাপতি এস এম ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ও উপজেলা জাপার আহবায়ক মেজবাহুল ইসলাম মনোনয়ন পেলে নির্বাচন করবেন এমনটা শোনা যাচ্ছে।

রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) :
পীরগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। পীরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-৬ আসনে টানা দুই যুগ রাজত্ব করেছে জাতীয় পার্টি। ৩৫ বছর পর নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে এ আসনটি উদ্ধার করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ি পীরগঞ্জ।

অষ্টম সংসদ নির্বাচনে এই আসনে শেখ হাসিনা জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুর মোহাম্মদ মন্ডলের কাছে সামান্য ভোটে পরাজিত হলেও নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে পরপর এমপি হন।

তখন থেকেই এ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে। তবে এবার আওয়ামী লীগ থেকে বিশিষ্ট শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম সিরাজ মনোনয়ন পেলে নির্বাচন করবেন এমনটা গুঞ্জন রয়েছে । এই আসনটি জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগকে ছাড় দিতে পারে এমনটা মনে করা হচ্ছে। তবে বিএনপির জেলা আহবায়ক সাইফুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির উপজেলা সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম জাদু এই আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে আগাম শোনা যাচ্ছে।